রিয়েল
ইমেজারি ও ইমেজারি রিয়েলের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনুভূতিশীল সৃজনশীল শিল্পীকে স্বকীয় করে
তুলবে একথা সত্য। শিল্পের পথে রিয়েল টু ইমেজারি ও ইমেজারি টু রিয়েলের জার্নিটা সংস্থানগত
খন্ড বাস্তবতা মাত্র। শিল্পী তার জীবনে রিয়েল থেকে ইমেজারি রিয়েলে যে পাড়ি জমায় সেই
পথে কল্পনা শক্তির প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখযোগ্য। কল্পনাকে রসদ করে ইমেজারি, দক্ষ সামগ্রিকতা
নির্ন্মাণের উপযুক্ত হয়। এই চলার পথে যদি সমগ্রতা নির্ন্মাণে শিল্পী ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে
ইমেজারি সেন্স ব্যহত হয় অনেকখানি। সামগ্রিকভাবে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে ইমেজারি
সেন্স আবার আলাদা আলাদা ভাবে কার্যকরী থাকে। স্বভাবতই সিনেমার ইমেজারী ভ্যালু ও কবিতার
ইমেজরী আবিষ্টতা একে অপরের থেকে ভিন্ন অবস্থানে রেখেছে নিজেদের। অন্য দিকে আবার ওয়েল
অ্যান্ড গুড ইমেজারি সেন্স যে কোনো শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রেই একই অনুভূতি কার্যকর করে
বলে মনে হ্য়। শিহরণটা সেখানে কবিতা বলে বা ভিজুয়াল এফেক্ট থাকছে না বলে ব্যহত হচ্ছে
একথা ভাবা অতুক্তি হবে। কবিতার নিরিখে সাতের দশক থেকে যে ভাবে ইমেজারি স্ফূরণ বাংলা
কবিতায় দেখা গিয়েছে তাতে একপ্রকার সচেতন বিনির্ন্মাণে তৎপরবর্তীকালে শিল্পগত উদ্দেশ্যকে
চরিতার্থ করেছে। ছবির ক্ষেত্রে আবার ইমেজারী হেঁটেছে মানবিক অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি হিসেবে।
ছবির দুনিয়ায় ইমেজারি সর্ব্বোচ্চ সমীকরণ যা দেখা যায় সেখানে সুরিয়ালিজম এক গভীর অর্থে
প্রকাশের দিকে ধাববান হয়েছে।রিয়ালিজম থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সুরিয়ালিজম যখন দাপট দেখাচ্ছে
ছবির ইতিহাসে সেখানে এসে ফ্যান্টাসি ইমেজারিকে নিয়ে যাচ্ছে নাটকীয়তার মাত্রায়। ছবির
বাস্তবতা সেখানে নতুন বাস্তবের ধারাকে সক্রিয় করে রেখেছে সর্বক্ষণ। আক্ষরিকভাবে বলতে
গেলে তাই সুরিয়ালিজমের ছবি ও লেখার ঘরানায় ইমেজারি এক অনবদ্য উপাদান হিসেবে থেকে গিয়েছে
নানান ভঙ্গিমাতে। রিয়ালিজমের ইমাজারি অন্য দিকে এক অমোঘ প্রকরণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরা
পড়ে, সেখানে ফ্যান্টাসি ছবিতে কোনো ডিসটর্শন হিসেবে ধরা না দিলেও চূড়ান্ত বাস্তবতার
ইমেজারি ভ্যালু হয়ে ওঠে আত্মসমর্পণের মতো ব্যাখ্যাহীন। ন্যাচারালিজমের থেকে আলাদা হয়ে
রিয়ালিজম যে ছবির টানটান উত্তেজনা তুলে ধরে দর্শক মনে তাকে অতিক্রান্ত করার একমাত্র
পথ খোলা থাকে সর্ব্বোচ্চ অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের হাতে। রিয়ালিজম যে অবিকল বাস্তবের রূপায়ন
নয় সেখানে যে শিল্পী বর্নিত প্রকাশ্যতার ধারা যে ঢুকে যায় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে
না। বিষয়ের মধ্যে আপাত বাস্তবতার কথা সঙ্গার্থ করার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যান্টাসি এক দর্শন
রূপে ধরা পড়ে। পরবর্তীকালে এই রিয়ালিজমের মধ্যে যুক্ত হয়েছে অতিনাটকীয়তা আর ছবি, কবিতা
এসে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক রিয়ালিজমের আঙ্গিনায়।
কিন্তু
ইমেজারির তাতে কি সুরাহা হল!সেকথা শৈলী নির্ন্মাণের ক্ষেত্রে কতটা জরুরী তা বিষয়ের
লিপ্ততা থেকে ধরা পড়ে। ম্যাজিক রিয়ালিজমে পরিত্রাণ খোঁজার চেষ্টা সুষ্পষ্ট। পরাধীন
ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায় ইমেজারি সেখানে নিয়েছে আপাত উদ্ভট কিছু প্রত্যক্ষ সর্বব্যাপী
ভঙ্গুরতা ও ভ্রূকুটি। ম্যাজিক রিয়ালিজমের জাদুটাই এখানে ছবি ও লেখাকে করেছে ইমেজারী
শক্তির সর্বগ্রাসময়তার এজেন্ট স্বরূপ। রিয়েল ইমেজারি ধরা পড়েছে নাটকীয় কিছু প্রেক্ষাপট
রচনা ও সম্প্রসারণ করার মধ্য দিয়ে। ইমেজারি প্রতিবাদহীন বেশ নির্লজ্জ ঢঙে বিধৃত থাকবে
সময় ও নিজস্ব চরিত্রের গঠন ও নির্ন্মাণ শৈলীর মধ্যে। যেখানে রিয়ালিজমের রোমান্টিকতা
পর্যবসিত হয় আশ্লেষ এবং বিক্ষুদ্ধতায়। বহুক্ষেত্রে ম্যাজিক রিয়ালিজম রিয়ালিজমের ক্যারিকেচার
রূপে ছবিতে উঠে আসলেও, বাস্তবতার পরিত্রাণে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ইমেজারি সমন্বয় একটি
গ্রাহ্যের মধ্য দিয়েই পরিস্ফূটিত হয়েছে। বিমূর্ততার কল্পনার ব্যঞ্জনায় ছবির উপস্থাপনা
ইমেজারিকে করেছে ভাস্বর। ইমেজারির গতিপ্রকৃতি, রঙের বাহারে অথবা রঙহীনতায় তার বক্তব্য
শিল্পীর কৃতিত্ব। তেমনি লেখার ক্ষেত্রেও শব্দালঙ্কার তথা দৃশ্যপট রচনায় শিল্পগুণ সম্পন্নতা,
অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা দাবী রেখে চলে। ইমেজারি সর্বস্বতার অদৃশ্য স্পর্শও ছবি বা লেখাকে
করে তুলতে পারে ভারাক্রান্ত। ইমেজারি তাই শিল্প সৃষ্টির পথে প্রাথমিক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য
একথা সঠিক মনে হয় না। তবে ইমেজারী ব্যতীত আর কিই বা আত্মমগ্ন শিল্পীকে পরিত্রাণ দিতে
পারে!
ইমেজারির
মানসিক সংগঠনতা যাচাই করা তাই যুক্তি সংগত নয়। ইমেজারিকে কল্পনায় ভর করে উড়তে দিয়েই
ছেড়ে দিলে তার বিস্তার অনেক দূর পর্যন্ত প্রাণবন্ত রূপে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। ইমেজারীকে
সঠিকভাবে গড়ে উঠতে হলে সঠিক ইমেজারির চরিত্র গড়ে ওঠা আবশ্যক। ইমেজারি যদি যাপনের সঙ্গে
একাত্মতা লাভ করতে পারে সেক্ষেত্রে ইমেজারি এক অন্য মাত্রা লাভ করে। ছবি বা লেখাকে
এজলেস হিসেবে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা একমাত্র দৃঢ় ও অভিজ্ঞ ইমেজারির রয়েছে, ইমেজারিকে
তাই সামাজিক নানান ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে একাত্ম করা শিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ।
শিল্পীর ঐকান্তিক চেষ্টা সংস্কৃতির নিরেট বুনটের মধ্য দিয়ে ইমেজারীকে নিয়ে যাওয়া। যেখানে
ঐতিহাসিকতার সঙ্গে ইমেজারির প্রাসঙ্গিকতাকে অন্তরঙ্গভাবে অনুশীলন করা অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে
নিয়ে যেতে পারে এক শিল্পীকে। যোগেন চোধূরী তাঁর ‘চিত্রকরের চিন্তাভাবনা’-য় বলেছেন-
“ছবির একটি ঐতিহাসিকতা থাকা দরকার, যে ঐতিহাসিকতা ছবিকে তাৎপর্য দেয় এবং যে তাৎপর্য
ছবিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়।” সুতরাং একটি ছবির আত্মা তার ইমেজারি চৌহদ্দিকে উদজীবিত
করার মধ্য দিয়েই প্রকাশ লাভ করে। এক্সপ্রেশনিজম মানুষের মননের সঙ্গে এমন ভাবে যুক্ত
যেখানে লেখা ও ছবিতে ইমেজারির এসেন্স ঢেলে সাজানোর কাজ এক সময় বিপুল আকারে হয়েছে। অতীন্দ্রিয়
চেতনা তথা বিমূর্ত ভাবনার ক্ষেত্রে ইমেজারির ধারণালদ্ধ ফল এক্ষেত্রে বারবার শিল্প ইতিহাসে
ঘুরে ফিরে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে ইমেজারি কেন এবং কিসের জন্য? একথা সত্য যে ইমেজারির
স্বতঃস্ফূর্ত্ত স্বাভাবিক প্রকাশের সর্ব্বোচ্চ অভিব্যক্তিময়তা অ্যাবস্ট্রাকশনকেই সনাক্ত
করে এবং দর্শককে অভিরুচি ও দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভরশীল রাখে। ইমেজারি যখন দর্শকের ওনার
পাইডকে স্যাটিসফাই করতে পারে তখন দৃশ্যগত ভাষার বিস্তার শিল্পবোধের ওপর জনপ্রিয়তাকে
সমানুপাতিক সম্পর্কে যাচাই করে নিতে জানে। সৎ সংবেদনশীল ইমেজারি সেন্স মানেই যে সর্বদা
শিল্পীর পেট ভরবে এইরকমটাও নয়। ফলে ইডিওলজির দিক থেকে শিল্পীর স্খালন ঘটতে থাকে এবং
ইমেজারীর ক্ষেত্রে একপ্রকারের কম্প্রমাইজ চলে আসে। সাংস্কৃতিক মাপকাঠিতে তাই ইমেজারি
নিজেকে সম্পূর্ন করার মধ্য দিয়ে পরিচিত হয় আর্টের সঙ্গে । ইমেজারির মৃত একথা যেমন সুনিশ্চিতভাবে
বলা যায় না তেমনি বহু ক্ষেত্রেই যে ইমেজারির মৃত্যু ঘটে শিল্পীর সংবেদনশীলতার
মাপকাঠির জন্য সে কথাও সত্য। যদিও ইমেজারির বনেদিয়ানাকে নিয়ে বিস্তর কাটা ছেড়া
ও শিল্প সমালোচকের শখ আলহাদ মেটানো হয়ে এসেছে তদানীন্তন কাল থেকেই। ইমেজারির বিষয়বস্তু,
করণকৌশল ও আঙ্গিকগত সকল দিক হতেই নতুনত্বকে বেশী প্রাধাণ্য দিয়ে এসেছে বরাবর। এইভাবে
ইমেজারিতে ফ্যাগমেনটেশন ও র্যানডমনেসের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য্ করা গিয়েছে উত্তর আধূনিক
শিল্পে।লেখার ক্ষেত্রে ইমেজারির নির্যাস রূপের নির্মানে অভিজ্ঞতাকে করেছে রসদ। ছবি
হয়ে উঠেছে অতীন্দ্রিয় চেতনার সারৎসার আর সিনেমা সেখান থেকে কয়েক ধাপ অন্য পথে হেঁটে
নিজেকে করে তুলেছে ইমেজারি প্রকটতার নান্দনিক মেলবন্ধনের প্রতিনিধি। ইমেজারি সৃজনশীলতার
ট্যাডিশনাল ওয়ে আউটের মধ্যে দিয়ে চলার চেষ্টা কখনো করেনি বলে ইমেজারির ভবিষ্যত হয়েছে
অনিশ্চয়তায় ভরা। ইকুইপড অথবা মেকানাইসড ভাবে ইমেজারিকে শিল্পের পথে হাঁটতে শেখানো যায়নি
কখনই। এখানেই ইমেজারির আসল মজা। ইমেজারি খুব ধীরে ধীরে তার সাজ সরঞ্জাম খুলে বসে, আচার
ব্যবহারের দিক থেকেও ইমেজারি বেশ ছিমছাম প্রকৃতির। তাই বলে তার আর্ট ভ্যলু যে কোনো
মাল্টিডিসিপ্লিনারি আর্ট মিডিয়াকেই উজ্জীবিত করতে পারে। ইমেজারির ইউনিলিনিয়ার ফরম্যাট
ছবির ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে এক্সপ্রেশনিজমের নামান্তর মাত্র। ইমেজারির পরীক্ষা নিরীক্ষা
কোন সঠিক পথে অগ্রসর হবে তা কিন্তু নিশ্চিত করে কখনই বলা যায় না।ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে
ইমেজারির রসদ পুরোপুরিই কল্পনা শক্তির দাপটের ওপর নির্ভর করে পরিস্ফূটিত হয়েছে। লেখায়
বা কবিতায়, ইমেজারি এসেছে ভাবনার অনুসঙ্গ হয়ে। ভাবনার কার্যকারণ সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে
কল্পনা অংশগ্রহন করেছে অভিব্যক্তির রূপায়নে। আবার ইমেজারি অবহেলিতও হয়েছে, নান্দনিক
গুণের যথার্ততা পায় নি এরকম ঘটনারও কিছু কম উদাহরণ নেই! দেশীয় শিল্পকলাকে বুঝতে চেষ্টা
করলে বা মূল্যায়ণের দিকে গেলে ইমেজারির আঙিনাটি যে মোটেও স্বল্পমূল্যের নয় সে কথা না
বলে পারা যায় না।মর্ডান তথা পোষ্টমর্ডান আর্তি ইমেজারিতে প্রবেশ করে তাকে করে তুলেছে
রাজনৈতিক রূপ ও গড়নের বহুমুখীনতায় সপৃক্ত। ইমেজারির রাজনৈতিক উন্মুক্ততা শিল্প চর্চার
পথকে দেয় বহুমুখী ক্রমবিবর্তন। দেশজ শিল্প এইভাবে ইমেজারি গুনেই একমাত্র পারে আঞ্চলিকতার
তকমাকে ঝেড়ে ফেলতে। ইমেজারি বিশ্বজনিন। শিল্পগুন ও স্বকীয়তায় তাকে সমৃদ্ধ করার পথে
শিল্পীকে থাকতে হবে নিযুক্ত। ইমেজারির মত্যু শিল্প মননকেই দূরে ঠেলে ফেলে দেবে বহুযোজন।
ইমেজারির দীর্ঘস্থায়ী হওয়া তাই শিল্পী মনের একান্ত কাম্য। ছবি আমাদের দেখতে শেখায়,
সেই দেখার পথে ইমেজারি এক বিশেষ শিল্পকলা নির্ভর মিডিয়াম যা ভাবনার স্তরকে তাৎপর্যপূর্ণ
ভাবে নিয়ে যায় প্রকাশ ভঙ্গিমার সঙ্গে দর্শকের মেলবন্ধন রচনায়।
ইমেজারির
মৃত্যু তাই সাময়িক এক বদ্ধতারই নামান্তর হতে পারে। ইমেজারিকে বাঁচতে শিখতে হয় শিল্পের
তাগিদে। তার রূপভেদ আলাদা আলাদা হয়ে যায় সেই এক একটি মৃত্যু পথ অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে,
যত বেশী করে মৃত্যু ঘটে ততো যেন শানিয়ে ওঠে ইমেজারির প্রকাশ ভঙ্গিমা সময়ের নিরিখে।ইমেজারির
মৃত্যু যদি অঘটন হয় সেক্ষেত্রে ইমেজারির দীর্ঘজীবী হওয়াটাও স্বতঃসিদ্ধ। ইমেজারিকে বাঁচতে
জানতে হয় শিল্পের তাগিদে। শিল্পের মাধ্যম সেখানে এক অছিলা মাত্র। ফ্যান্টাসী, কল্পনা,
ভাবনার বিস্তার যতদিন মানব মননকে প্রভাবিত করবে ইমেজারির বাড়বাড়ন্ত ততোদিন ধরা পড়বেই
নানান মাধ্যমের মধ্য দিয়ে।