Friday, November 10, 2017

ইমেজারি বিষয়ক

রিয়েল ইমেজারি ও ইমেজারি রিয়েলের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনুভূতিশীল সৃজনশীল শিল্পীকে স্বকীয় করে তুলবে একথা সত্য। শিল্পের পথে রিয়েল টু ইমেজারি ও ইমেজারি টু রিয়েলের জার্নিটা সংস্থানগত খন্ড বাস্তবতা মাত্র। শিল্পী তার জীবনে রিয়েল থেকে ইমেজারি রিয়েলে যে পাড়ি জমায় সেই পথে কল্পনা শক্তির প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখযোগ্য। কল্পনাকে রসদ করে ইমেজারি, দক্ষ সামগ্রিকতা নির্ন্মাণের উপযুক্ত হয়। এই চলার পথে যদি সমগ্রতা নির্ন্মাণে শিল্পী ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে ইমেজারি সেন্স ব্যহত হয় অনেকখানি। সামগ্রিকভাবে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে ইমেজারি সেন্স আবার আলাদা আলাদা ভাবে কার্যকরী থাকে। স্বভাবতই সিনেমার ইমেজারী ভ্যালু ও কবিতার ইমেজরী আবিষ্টতা একে অপরের থেকে ভিন্ন অবস্থানে রেখেছে নিজেদের। অন্য দিকে আবার ওয়েল অ্যান্ড গুড ইমেজারি সেন্স যে কোনো শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রেই একই অনুভূতি কার্যকর করে বলে মনে হ্য়। শিহরণটা সেখানে কবিতা বলে বা ভিজুয়াল এফেক্ট থাকছে না বলে ব্যহত হচ্ছে একথা ভাবা অতুক্তি হবে। কবিতার নিরিখে সাতের দশক থেকে যে ভাবে ইমেজারি স্ফূরণ বাংলা কবিতায় দেখা গিয়েছে তাতে একপ্রকার সচেতন বিনির্ন্মাণে তৎপরবর্তীকালে শিল্পগত উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করেছে। ছবির ক্ষেত্রে আবার ইমেজারী হেঁটেছে মানবিক অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি হিসেবে। ছবির দুনিয়ায় ইমেজারি সর্ব্বোচ্চ সমীকরণ যা দেখা যায় সেখানে সুরিয়ালিজম এক গভীর অর্থে প্রকাশের দিকে ধাববান হয়েছে।রিয়ালিজম থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সুরিয়ালিজম যখন দাপট দেখাচ্ছে ছবির ইতিহাসে সেখানে এসে ফ্যান্টাসি ইমেজারিকে নিয়ে যাচ্ছে নাটকীয়তার মাত্রায়। ছবির বাস্তবতা সেখানে নতুন বাস্তবের ধারাকে সক্রিয় করে রেখেছে সর্বক্ষণ। আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে তাই সুরিয়ালিজমের ছবি ও লেখার ঘরানায় ইমেজারি এক অনবদ্য উপাদান হিসেবে থেকে গিয়েছে নানান ভঙ্গিমাতে। রিয়ালিজমের ইমাজারি অন্য দিকে এক অমোঘ প্রকরণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরা পড়ে, সেখানে ফ্যান্টাসি ছবিতে কোনো ডিসটর্শন হিসেবে ধরা না দিলেও চূড়ান্ত বাস্তবতার ইমেজারি ভ্যালু হয়ে ওঠে আত্মসমর্পণের মতো ব্যাখ্যাহীন। ন্যাচারালিজমের থেকে আলাদা হয়ে রিয়ালিজম যে ছবির টানটান উত্তেজনা তুলে ধরে দর্শক মনে তাকে অতিক্রান্ত করার একমাত্র পথ খোলা থাকে সর্ব্বোচ্চ অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের হাতে। রিয়ালিজম যে অবিকল বাস্তবের রূপায়ন নয় সেখানে যে শিল্পী বর্নিত প্রকাশ্যতার ধারা যে ঢুকে যায় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়ের মধ্যে আপাত বাস্তবতার কথা সঙ্গার্থ করার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যান্টাসি এক দর্শন রূপে ধরা পড়ে। পরবর্তীকালে এই রিয়ালিজমের মধ্যে যুক্ত হয়েছে অতিনাটকীয়তা আর ছবি, কবিতা এসে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক রিয়ালিজমের আঙ্গিনায়।
কিন্তু ইমেজারির তাতে কি সুরাহা হল!সেকথা শৈলী নির্ন্মাণের ক্ষেত্রে কতটা জরুরী তা বিষয়ের লিপ্ততা থেকে ধরা পড়ে। ম্যাজিক রিয়ালিজমে পরিত্রাণ খোঁজার চেষ্টা সুষ্পষ্ট। পরাধীন ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায় ইমেজারি সেখানে নিয়েছে আপাত উদ্ভট কিছু প্রত্যক্ষ সর্বব্যাপী ভঙ্গুরতা ও ভ্রূকুটি। ম্যাজিক রিয়ালিজমের জাদুটাই এখানে ছবি ও লেখাকে করেছে ইমেজারী শক্তির সর্বগ্রাসময়তার এজেন্ট স্বরূপ। রিয়েল ইমেজারি ধরা পড়েছে নাটকীয় কিছু প্রেক্ষাপট রচনা ও সম্প্রসারণ করার মধ্য দিয়ে। ইমেজারি প্রতিবাদহীন বেশ নির্লজ্জ ঢঙে বিধৃত থাকবে সময় ও নিজস্ব চরিত্রের গঠন ও নির্ন্মাণ শৈলীর মধ্যে। যেখানে রিয়ালিজমের রোমান্টিকতা পর্যবসিত হয় আশ্লেষ এবং বিক্ষুদ্ধতায়। বহুক্ষেত্রে ম্যাজিক রিয়ালিজম রিয়ালিজমের ক্যারিকেচার রূপে ছবিতে উঠে আসলেও, বাস্তবতার পরিত্রাণে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ইমেজারি সমন্বয় একটি গ্রাহ্যের মধ্য দিয়েই পরিস্ফূটিত হয়েছে। বিমূর্ততার কল্পনার ব্যঞ্জনায় ছবির উপস্থাপনা ইমেজারিকে করেছে ভাস্বর। ইমেজারির গতিপ্রকৃতি, রঙের বাহারে অথবা রঙহীনতায় তার বক্তব্য শিল্পীর কৃতিত্ব। তেমনি লেখার ক্ষেত্রেও শব্দালঙ্কার তথা দৃশ্যপট রচনায় শিল্পগুণ সম্পন্নতা, অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা দাবী রেখে চলে। ইমেজারি সর্বস্বতার অদৃশ্য স্পর্শও ছবি বা লেখাকে করে তুলতে পারে ভারাক্রান্ত। ইমেজারি তাই শিল্প সৃষ্টির পথে প্রাথমিক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য একথা সঠিক মনে হয় না। তবে ইমেজারী ব্যতীত আর কিই বা আত্মমগ্ন শিল্পীকে পরিত্রাণ দিতে পারে!
ইমেজারির মানসিক সংগঠনতা যাচাই করা তাই যুক্তি সংগত নয়। ইমেজারিকে কল্পনায় ভর করে উড়তে দিয়েই ছেড়ে দিলে তার বিস্তার অনেক দূর পর্যন্ত প্রাণবন্ত রূপে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। ইমেজারীকে সঠিকভাবে গড়ে উঠতে হলে সঠিক ইমেজারির চরিত্র গড়ে ওঠা আবশ্যক। ইমেজারি যদি যাপনের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করতে পারে সেক্ষেত্রে ইমেজারি এক অন্য মাত্রা লাভ করে। ছবি বা লেখাকে এজলেস হিসেবে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা একমাত্র দৃঢ় ও অভিজ্ঞ ইমেজারির রয়েছে, ইমেজারিকে তাই সামাজিক নানান ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে একাত্ম করা শিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। শিল্পীর ঐকান্তিক চেষ্টা সংস্কৃতির নিরেট বুনটের মধ্য দিয়ে ইমেজারীকে নিয়ে যাওয়া। যেখানে ঐতিহাসিকতার সঙ্গে ইমেজারির প্রাসঙ্গিকতাকে অন্তরঙ্গভাবে অনুশীলন করা অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে নিয়ে যেতে পারে এক শিল্পীকে। যোগেন চোধূরী তাঁর ‘চিত্রকরের চিন্তাভাবনা’-য় বলেছেন- “ছবির একটি ঐতিহাসিকতা থাকা দরকার, যে ঐতিহাসিকতা ছবিকে তাৎপর্য দেয় এবং যে তাৎপর্য ছবিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়।” সুতরাং একটি ছবির আত্মা তার ইমেজারি চৌহদ্দিকে উদজীবিত করার মধ্য দিয়েই প্রকাশ লাভ করে। এক্সপ্রেশনিজম মানুষের মননের সঙ্গে এমন ভাবে যুক্ত যেখানে লেখা ও ছবিতে ইমেজারির এসেন্স ঢেলে সাজানোর কাজ এক সময় বিপুল আকারে হয়েছে। অতীন্দ্রিয় চেতনা তথা বিমূর্ত ভাবনার ক্ষেত্রে ইমেজারির ধারণালদ্ধ ফল এক্ষেত্রে বারবার শিল্প ইতিহাসে ঘুরে ফিরে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে ইমেজারি কেন এবং কিসের জন্য? একথা সত্য যে ইমেজারির স্বতঃস্ফূর্ত্ত স্বাভাবিক প্রকাশের সর্ব্বোচ্চ অভিব্যক্তিময়তা অ্যাবস্ট্রাকশনকেই সনাক্ত করে এবং দর্শককে অভিরুচি ও দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভরশীল রাখে। ইমেজারি যখন দর্শকের ওনার পাইডকে স্যাটিসফাই করতে পারে তখন দৃশ্যগত ভাষার বিস্তার শিল্পবোধের ওপর জনপ্রিয়তাকে সমানুপাতিক সম্পর্কে যাচাই করে নিতে জানে। সৎ সংবেদনশীল ইমেজারি সেন্স মানেই যে সর্বদা শিল্পীর পেট ভরবে এইরকমটাও নয়। ফলে ইডিওলজির দিক থেকে শিল্পীর স্খালন ঘটতে থাকে এবং ইমেজারীর ক্ষেত্রে একপ্রকারের কম্প্রমাইজ চলে আসে। সাংস্কৃতিক মাপকাঠিতে তাই ইমেজারি নিজেকে সম্পূর্ন করার মধ্য দিয়ে পরিচিত হয় আর্টের সঙ্গে । ইমেজারির মৃত একথা যেমন সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না তেমনি বহু ক্ষেত্রেই যে ইমেজারির মৃত্যু ঘটে শিল্পীর  সংবেদনশীলতার  মাপকাঠির জন্য সে কথাও সত্য। যদিও ইমেজারির বনেদিয়ানাকে নিয়ে বিস্তর কাটা ছেড়া ও শিল্প সমালোচকের শখ আলহাদ মেটানো হয়ে এসেছে তদানীন্তন কাল থেকেই। ইমেজারির বিষয়বস্তু, করণকৌশল ও আঙ্গিকগত সকল দিক হতেই নতুনত্বকে বেশী প্রাধাণ্য দিয়ে এসেছে বরাবর। এইভাবে ইমেজারিতে ফ্যাগমেনটেশন ও র‌্যানডমনেসের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য্ করা গিয়েছে উত্তর আধূনিক শিল্পে।লেখার ক্ষেত্রে ইমেজারির নির্যাস রূপের নির্মানে অভিজ্ঞতাকে করেছে রসদ। ছবি হয়ে উঠেছে অতীন্দ্রিয় চেতনার সারৎসার আর সিনেমা সেখান থেকে কয়েক ধাপ অন্য পথে হেঁটে নিজেকে করে তুলেছে ইমেজারি প্রকটতার নান্দনিক মেলবন্ধনের প্রতিনিধি। ইমেজারি সৃজনশীলতার ট্যাডিশনাল ওয়ে আউটের মধ্যে দিয়ে চলার চেষ্টা কখনো করেনি বলে ইমেজারির ভবিষ্যত হয়েছে অনিশ্চয়তায় ভরা। ইকুইপড অথবা মেকানাইসড ভাবে ইমেজারিকে শিল্পের পথে হাঁটতে শেখানো যায়নি কখনই। এখানেই ইমেজারির আসল মজা। ইমেজারি খুব ধীরে ধীরে তার সাজ সরঞ্জাম খুলে বসে, আচার ব্যবহারের দিক থেকেও ইমেজারি বেশ ছিমছাম প্রকৃতির। তাই বলে তার আর্ট ভ্যলু যে কোনো মাল্টিডিসিপ্লিনারি আর্ট মিডিয়াকেই উজ্জীবিত করতে পারে। ইমেজারির ইউনিলিনিয়ার ফরম্যাট ছবির ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে এক্সপ্রেশনিজমের নামান্তর মাত্র। ইমেজারির পরীক্ষা নিরীক্ষা কোন সঠিক পথে অগ্রসর হবে তা কিন্তু নিশ্চিত করে কখনই বলা যায় না।ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে ইমেজারির রসদ পুরোপুরিই কল্পনা শক্তির দাপটের ওপর নির্ভর করে পরিস্ফূটিত হয়েছে। লেখায় বা কবিতায়, ইমেজারি এসেছে ভাবনার অনুসঙ্গ হয়ে। ভাবনার কার্যকারণ সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে কল্পনা অংশগ্রহন করেছে অভিব্যক্তির রূপায়নে। আবার ইমেজারি অবহেলিতও হয়েছে, নান্দনিক গুণের যথার্ততা পায় নি এরকম ঘটনারও কিছু কম উদাহরণ নেই! দেশীয় শিল্পকলাকে বুঝতে চেষ্টা করলে বা মূল্যায়ণের দিকে গেলে ইমেজারির আঙিনাটি যে মোটেও স্বল্পমূল্যের নয় সে কথা না বলে পারা যায় না।মর্ডান তথা পোষ্টমর্ডান আর্তি ইমেজারিতে প্রবেশ করে তাকে করে তুলেছে রাজনৈতিক রূপ ও গড়নের বহুমুখীনতায় সপৃক্ত। ইমেজারির রাজনৈতিক উন্মুক্ততা শিল্প চর্চার পথকে দেয় বহুমুখী ক্রমবিবর্তন। দেশজ শিল্প এইভাবে ইমেজারি গুনেই একমাত্র পারে আঞ্চলিকতার তকমাকে ঝেড়ে ফেলতে। ইমেজারি বিশ্বজনিন। শিল্পগুন ও স্বকীয়তায় তাকে সমৃদ্ধ করার পথে শিল্পীকে থাকতে হবে নিযুক্ত। ইমেজারির মত্যু শিল্প মননকেই দূরে ঠেলে ফেলে দেবে বহুযোজন। ইমেজারির দীর্ঘস্থায়ী হওয়া তাই শিল্পী মনের একান্ত কাম্য। ছবি আমাদের দেখতে শেখায়, সেই দেখার পথে ইমেজারি এক বিশেষ শিল্পকলা নির্ভর মিডিয়াম যা ভাবনার স্তরকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নিয়ে যায় প্রকাশ ভঙ্গিমার সঙ্গে দর্শকের মেলবন্ধন রচনায়।

ইমেজারির মৃত্যু তাই সাময়িক এক বদ্ধতারই নামান্তর হতে পারে। ইমেজারিকে বাঁচতে শিখতে হয় শিল্পের তাগিদে। তার রূপভেদ আলাদা আলাদা হয়ে যায় সেই এক একটি মৃত্যু পথ অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে, যত বেশী করে মৃত্যু ঘটে ততো যেন শানিয়ে ওঠে ইমেজারির প্রকাশ ভঙ্গিমা সময়ের নিরিখে।ইমেজারির মৃত্যু যদি অঘটন হয় সেক্ষেত্রে ইমেজারির দীর্ঘজীবী হওয়াটাও স্বতঃসিদ্ধ। ইমেজারিকে বাঁচতে জানতে হয় শিল্পের তাগিদে। শিল্পের মাধ্যম সেখানে এক অছিলা মাত্র। ফ্যান্টাসী, কল্পনা, ভাবনার বিস্তার যতদিন মানব মননকে প্রভাবিত করবে ইমেজারির বাড়বাড়ন্ত ততোদিন ধরা পড়বেই নানান মাধ্যমের মধ্য দিয়ে।        

Saturday, November 4, 2017

ইমেজ মেকিং ও সমকালীন চিত্রকলা

সমকালীন ছবির জগতে ইমেজ মেকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিগ্রহন করতে চলেছে। সমকালীনতাকে ছাপিয়ে ছবির ইতিহাস যা কিনা চিরন্তন হওয়ার দাবী রাখে সেখানে দাঁড়িয়ে ছবির ইমেজ মেকিং কতটা ভাষ্বর ভূমিকা প্রতিপালন করবে সে কথা বলার সময় এখনো আসে নি। কিন্তু সমকালীনতা ছুটছে ইমেজ মেকিংকে নতুনভাবে প্রতিষ্টা করার মধ্য দিয়েই। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় তথা বিশ্ব শিল্পকলার জগতে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে ছবির ইতিহাসের খুঁটিনাটি পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার। ইতিহাস বিচ্যুত শিল্পকলার চর্চা অনেক বেশী করে আর্টিস্টদের ঠেলে দিচ্ছে ইমেজ মেকিংয়ের দিকে। ফলত ছবির সনাতন ঘরানাগুলোকে টিকে থাকতে হচ্ছে যুদ্ধ করে। এ প্রসঙ্গেই যদি কলকাতার প্রাচীন তেলরঙের ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায় দেখা যাবে বহু ছবির খোঁজ এখন সঠিকভাবে কেউ রাখেই না। কলকাতার প্রাচীন তেলরঙের ছবির পাশাপাশি এই সময় দরজার পাল্লা ও জানালার শার্সিতে আঁকা ধর্মীয় ও পৌরাণিক ছবি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু এই ছবিগুলকে নিয়ে আলোচনা তথা সমালোচনা কোনোটাই বিশেষভাবে হয় নি। কেবলমাত্র জয়া আপ্পাস্বামীর একটি ছোট লেখা ছাড়া এ বিষয়ে কোনো লেখাও আর হয়েছে বলে জানা নেই। কলকাতার এই তৈলচিত্রগুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণই হল এই ইমেজ মেকিংয়ের গোড়ার বিবর্তনটিকে ধরতে চাওয়া বাংলার ছবির ক্ষেত্রে। ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহানী নিয়ে শার্সীতে ছবি বাগবাজারের নন্দলাল আর পশুপতি বসুর বাড়ী ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। শৈলীর দিক হতে এই ছবিগুলোতে কালিঘাট শিল্পের সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য আছে তেমনি এর সুক্ষূতা কিন্তু রাজস্থানের মিনিয়েচার ফরম্যাটের। যাই হোক কথা হচ্ছিল ইমেজ মেকিং নিয়ে, তো ইমেজ মেকিংয়ের গোড়ার কাহানী চিত্রগুলি কালীঘাট পটুয়াদের কাছ থেকে যে সুচারু বিভঙ্গে আমরা পাচ্ছি তারই বিবর্তিত মনন বর্তমান ইমেজ মেকিংয়ের মধ্যে ধরা পড়ে। কালীঘাট শৈলীর বিখ্যাত ছবি বিড়াল তপস্বী যার ইমেজ মেকিং সেন্স ও ডাইমেনশন এখনো বিশ্ম্য় উৎপন্ন করে। আর এখানেই ডাইমেনশন নতুন দিকে যেমন অগ্রসর হয়েছে তেমনি ছবির রিপ্রেজেনটেশন ভ্যালু ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে হয়। একথা ঠিক যে এই অভাগা বঙ্গে তৈলচিত্রের ভবিষ্যত আর নেই বললেই চলে। বাজার অধিগ্রহন করেছে অ্যাক্রেলিক ও ডিজিটাল প্রিন্ট মিডিয়াম।
কালীঘাট তৈলচিত্রের পাশাপাশি ইমেজ মেকিংয়ে আরেকটি বড় ভূমিকা পালন করেছে এই বঙ্গের কাঠ খোদাই শিল্প। কাষ্ঠ খোদাইয়ের অবয়ব সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাঠের শিল্পের একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। অবয়ব ছাড়া সেখানে অন্য কোনো ইমেজ প্রভাব বিস্তার করে নাই। রেখা সেখানে মান্যতা পেয়েছে। আমদের দেশে রেখা আলোর অংশ। রেখা আমাদের দেশে আলোর অস্বিত্বকেই প্রমাণ করে, আলোকেই বর্ণনা করে। আবার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হতে সেই রেখাকেই দেখলে দেখবো কালীঘাট পটে রেখা, কাঁপা কাঁপা রেখা- যা সমস্ত ছবিকে বিস্তার করে। এইসব রেখার চলন সকল অবয়বের ডৌলত্ব ও আলোর রূপকে ব্যক্ত করে থাকে। এখানেই প্রথম বোঝা যায় যে ফ্ল্যাট রেখার চাইতে চরিত্র প্রাপ্ত হয়ে এই রেখাগুলো ছবিকে উত্তীর্ণ করেছে অনেকাংশে। এইভাবে রেখার ঘনত্ব ও রেখার চরিত্র দ্বারা ইমেজ মেকিংকে সমিচীন যুগপদ করে তুলেছিলেন কালীঘাটের পটুয়ারা। বাংলার ইমেজ মেকিং আদিম সত্যকে এইভাবে তুলে ধরেছিল রেখার গুনাগুনে।আমরা আমদের ইন্দ্রিয় দ্বারা সকল বস্তুকে বিভিন্ন রূপে গ্রহণ করে থাকি। ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা থেকে যে রেখা উঠে আসে সেই রেখার বোধ ও ভাবাবেগের পরিসর অনেক দূর ব্যপত। শিল্পের ক্ষেত্রে এইভাবে রেখা এবং রেখাকে ছুঁয়ে ইমেজ মেকিং গাম্ভীর্য ও রসবোধের সঞ্চার করে থাকে ছবিতে। স্বাভাবিক বোধ ও মার্জিত রুচির এক্ষেত্রে ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রেখার চলন যেহেতু আকর্ষক সে ক্ষেত্রে মননের বাইরে রেখার রুচির বিকার প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে রেখার চলনকে ইন্দ্রিয়জ রুচি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেখলে ইমেজ মেকিংকেও দেখা যাবে অনেক সদর্থক অর্থে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়- The principle of judgement depends upon experience and observation and not upon the strength or weakness of a natural faculty and it is form this difference in knowledge that we commonly call a difference in teste proceeds. (Philisophical Enquiry into the Origin of Ideas of the Sublime and Beautiful, by Burke.) রেখায় তাই সুন্দর বস্তুকে সুন্দর দেখায়। সৌন্দর্যের দুটি স্থান তাই পরিলক্ষিত হয়, একটি পরিস্ফূর্তি বা প্রকাশ(Expression) অন্যটি হল সত্য বা Truth. এইভাবে এই দুয়ের চর্চা ব্যতীত চিত্রীর শিল্পে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটা সম্ভবপর নয়। এই দুয়ের মধ্যে অর্থাৎ জ্ঞানবৃত্তি ও ইচ্ছাবৃত্তির মধ্যে সামঞ্জস্য সংঘটিত করা সম্ভবপর। কান্ট এই সৌন্দর্যবৃত্তির অনুশীলনকে জাজমেন্টের অন্তর্গত করেছেন। এইভাবে উঠে এসেছে উদাত্ত রস তথা গাম্ভীর্য রস। রসবোধ হল অতএব সেই অমোঘ পদসঞ্চার যা রেখার ভবিষ্যতকে সুনির্দিষ্ট করতে তৎপর হয়। রস ও রসবোধের আড়ালে আধুনিককালে রেখার প্রয়োগ বৈচিত্র্য নতুন মাত্রা প্রসার করেছে। ছবিতে বাস্তবকে ভেদ করার সর্ব্বধিক প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে সামনে উঠে এসেছে ইমেজ মেকিং।
ভারতীয় আর্য সভ্যতার হাতে শিল্পকলা তথা রসবোধ যেভাবে সঞ্চরণশীল, ভারতের অনার্য শিল্পকলা ততোধিক উল্টোপথে নিজের সৃজনকে পরিব্যপ্ত করেছে। অনার্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে রেখার যে দাপট লক্ষ্য করা যায় তার রূপান্তরণের সীমা ইন্দ্রিয়জ উপলদ্ধিকে করে তুলেছে অমোঘ। অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্খিত রেখার চমক সৌন্দর্য সৃষ্টিকে করে তুলেছে অনুভূতি ও আবেগের যুগপদ অন্তঃকরণ স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথের ছবির উদাহরণ এক্ষেত্রে এক অবশ্যম্ভাবী সৃষ্টির ক্রিয়াকে আমাদের সামনে প্রকট করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের ছবির চলন তার রেখা ও রঙের অস্ফূট আভিব্যক্তি অনুমানকে পরিণত করেছে সত্যে। এই সত্য ছবির সত্য, এ সত্য রেখার, আবহের, রঙের তথা অভিব্যক্তির। ওরিয়েন্টাল স্কুলের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের এই ছবির জগত ইমেজ মেকিংয়ের সনাতন রূপটিকে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধপ্রনালীর সংহত প্রকাশ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। রেখার সর্ব্বৈব সত্য এক্ষেত্রে রসবোধের আড়ালে মান্যতা প্রদান করেছে কল্পনাকে। কল্পনার দাপট রূপকে রূপান্তর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ওঠে। এইভাবে কল্পনা হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার সমষ্টি। অভিজ্ঞতা নিজস্ব গেস্টাল্টকে অব্যাহত রাখে আত্ম্পরিচয়ের মধ্য দিয়ে। ফলত শিল্পের সেলফ রিয়ালাইজেশন চিত্রীকে করে তোলে সংশ্লিষ্ট ছবির প্রতি তাত্তিকসত্তাবিহীন। আর এখানে এসেই ঠিক ঠিক অর্থে যাপনের নক্সা অঙ্কিত হওয়ার তুলনায় আলাদা ভাবে ধরা দেয় ইমেজ মেকিং। কিন্তু এই পথ চির রহস্য ঘেরা। রবীন্দ্রনাথের ছবির স্পর্শ চেতনা বিচিত্রতার পথে কখনোই দর্শককে নিয়ে যায় না বরং  মনকে নিবিষ্ট করতে সাহায্য করে প্রকৃত সৌন্দর্যবোধের ঝোঁককে স্বীকৃতি দিতে। আর এইভাবে রবীন্দ্রনাথের ছবির রেখা ও রঙের স্পর্শের মধ্য দিয়ে এসে লজিকাল ফ্যাকাল্টি ইমেজ মেকিংকে প্রতিষ্টিত করে সৌন্দর্য নিরীক্ষণে।   
বাংলায় রেখার কাজের অন্যতম পথিকৃত নন্দলাল বসু এবং তাঁর লিনোকাটের কাজগুলকে নিয়ে পর্যালোচনা না করলে ইমেজ মেকিং অনেকটাই অসম্পূর্ন থেকে যায়। ওরিয়েন্টাল স্কুলের অনেক সদস্যই এই উডকাট তথা লিনো কাটের কাজের মধ্য দিয়ে এক্সপ্রেশনকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছেন। প্রকাশ এখানে আর্টের এক অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে সৌন্দর্যবোধকে অনুভূতির অন্তরালে নিয়ে আসে। সহজ সরল রেখার দাপটে বিপর্যস্ত করে ইনটিউশনকে। এক্সপ্রেশন হয়ে ওঠে একান্ত মান্যতার অভিব্যক্তি স্বরূপ। সকলেই বিশ্বাস করে যে রঙের আলাদা মাধুর্য রয়েছে। রঙের জন্য রঙকে প্রকাশ করা একথা যেমন সত্য তেমনি লিনোকাটের সাদা কালো কাজগুলো অথবা সহজ পাঠের রেখার কাজ গুলো কিন্তু সাদা কালো হওয়া সত্ত্বেও রঙের মাধুর্য্যের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। রঙ তাই ইমেজ মেকিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে যথাযথভাবে বুঝতে সাহায্য করে যার যাত্রাপথ শুরু সাদা কালো ছবির হাত ধরে। তথাপি ইমেজ মেকিংয়ের সর্বাপেক্ষা বিকৃতির জায়গা ধরা থাকে এই রঙের প্রয়োগের মধ্যেই।
কমল কুমার মজুমদার তাঁর বঙ্গীয় শিল্পধারা ও অনান্য প্রবন্ধ গ্রন্থে বলেছেন যে- “রঙের স্পন্দন একদিক হইতে সর্ব্বৈব সত্য অন্য দিক হইতে তেমনই আংশিক সত্য। কেননা বস্তুর বাস্তবতা যেখানে দূরে পড়িয়া থাকে শুধু কতগুলি ছন্দময় রঙ সৃষ্টি করিয়া একটি মায়ার সৃষ্টিই হয়, বাস্তব সমস্ত কিছু আসিলেই ছবির লক্ষণযুক্ত হইবে। তাই ঠিক রূপটা ওখানে আসে নাই, সূর্য্যালোকের ব্যাপার লাবন্য বিষেশত্ব হিসেবেই আছে, আলো ঠিক এখানে ওখানে সেখানে পড়িয়াছে, ব্যক্তিগতভাবে তাহাকে দেখানো হইয়াছে। আলোর যে গভীরতা ঠিক ছবির সীমা ধরিয়া আসে নাই। আমরা তো তাহাকে একটা ছল আলোক ফেলিয়া ঠিক হইয়াছে বলি, সেটাও দেখা যাইবে একটি স্মৃতি আলোক ফেলিয়া বেশ দক্ষতার সঙ্গে আঁকা। কোথাও আলো আর রঙের লীলাটা তেমনভাবে স্থান সংগ্রহ করিতে পারে নাই।’’ – ইমেজ মেকিংয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যাটির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচ্ছন্ন ইমেজ মেকিং হতে কিভাবে রঙ ও আলো নিজ নিজ দিশা খুঁজে নিতে তৎপর হয় ওপরের অংশটুকু পঠনেই তা প্রত্যক্ষভাবে ধরা পড়ে। ফলে রঙের খেলা কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় অবয়বকে ঘিরে। অবয়ব যখন ইমেজ মেকিংয়ের মুখ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসে তখনই রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজের ক্ষমতাটুকুকে প্রকাশিত করতে পারে মাত্র তার বেশী কিছু হয়ে ওঠার ক্ষমতা রঙ হারিয়ে ফেলে। সাম্প্রতিক ছবির জগতে এই প্রকাশ ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে বলে ইমেজ মেকিং নিয়ে সন্দিহান দৃষ্টি উঠে আসে।
অন্য প্রান্তে রয়েছে অনার্য শিল্পকলারীতি যেখানে সরল কিছু রেখা অমোঘ স্পর্শের কথা নতুন ডাইমেনশনের দিক নিয়ে ইমেজ মেকিংকে করে তুলেছে শক্তপোক্ত ভীত্তির ওপর যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল। অনার্য শিল্প কথার সারেই  রয়েছে রেখা ও তার গতিপ্রকৃতি। রেখা সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টিতে এক সতন্ত্র বৃত্তি তৈরী করতে সক্ষম। স্বকীয় অখন্ডতার মধ্যে রস বোধ উপভোগ করার জন্য অবলম্বন হিসেবে উঠে এসেছে রেখার চলন। ক্রিয়েশন অনার্য শিল্পকলা পদ্ধতির একটি অন্তরের দৃষ্টি স্বরূপ। যেখানে ছবিতে কতগুলো রঙের সংমিশ্রন কেবল ঘটে না, রসেরও তাৎপর্য ছবিকে করে তোলে বাগ্ময়। অনার্য শিল্পের কন্টেন্ট ও ফর্মের দিক হতে তাই ইমেজ মেকিং অনেক শক্ত প্রকাশ ভঙ্গিমাকে আশ্রয় করে নিজের উন্মিলন ঘটায়। ছবি এইভাবে মূর্ত অর্থকে প্রকাশ করে থাকে, যার অ্যাস্থেটিক ভ্যালু নতুননভাবে দেখা দেয় ছবির ক্ষেত্র বিশেষে।
ইমেজ মেকিংয়ের গোড়ার কথা তাই ছবিকে হয়ে উঠতে হবে সৌন্দর্য বেদনের যুগপদ ফসল স্বরূপ। ইমেজ মেকিং
সেখানে ছবির মুখ্যত সঞ্চালিকা শক্তি না হয়ে যদি সামগ্রিক প্রকাশ ভঙ্গিমাকে অনুধাবন করা যায় তাহলে ছবির 
রস বোধ উত্তীর্ণ হয় নতুন মাত্রায়। কান্টিয় তত্ত্বের রেশ ধরে রেখেই ছবিকে সেখানে ভাগ করা যায় দুটি অংশে এক হলো ছবির স্বরূপ বা form দুই তার বস্তুতা বা quality। ইমেজ মেকিংয়ের গড়ায় রয়েছে এই দুই পন্থাকে উপভোগ করে তাকে আত্তীকরণ করার সদিচ্ছা। আর এরজন্যই দরকার নিরবিছিন্ন ছবির ইতিহাসের মোড়কগুলোকে উদঘাটন করা, তার চর্চা করা এবং ছবির ইতিহাসকে আত্মস্থ করা।

টেম্পেরামেন্ট ও ভারতীয় শিল্পকলা

ভারতীয় ছবিকে টেম্পেরামেন্টের দিক হতে দেখতে হলে, অনেক বেশী পরিশিলিত মনে হয়। ছবি নান্দনিক দিক হতে কতটা অভিরুচির প্রত্যয় ব্যক্ত করবে তার পরিমান নির্ভর করে ছবির টেম্পেরামেন্টের ওপর। ছবির নন্দনতত্ত্বের দিকগুলো খুঁতিয়ে দেখলে টেম্পেরামেন্ট ছবির প্রাণসঞ্চারকারী উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। ভারতীয় ছবিকে ব্যাখ্যা করলে তিনটি প্রধান অংশ পাই, এক- রেখা, দুই- রঙ, আর তিন- আকার। টেম্পেরামেন্ট ছবির এই তিনটি উপাদানের সঙ্গেই ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। টেম্পেরামেন্টের ধরণ ধারণ আবার বেশী ভাস্বর ও আলোচনা সাপেক্ষ হয়ে যায় যদি সেকুলার আর্ট ফর্মকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেকুলার আর্ট ভারতীয় শিল্পের প্রাণকেন্দ্র, কোনভাবেই চিত্রশিল্পের ইতিহাস সেকুলার আর্টকে উপেক্ষা করে বিস্তৃত হতে পারে নি। চেতন, অতিচেতন তথা অধিচেতনার হাত ধরে ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে নানান সেকুলার এলিমেন্ট উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি করেছে সেকুলার আর্ট ফর্মের শিল্প নির্মাণগত পরিকাঠামোগুলোকে। ফলস্বরূপ ছবিতে জনজীবন মাত্রা পেয়েছে অনেক মূর্ত আকারে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলীতে প্রসঙ্গত বলেছেন, শিল্প আঙ্গিক শিল্প মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ স্থান অধিগ্রহন করলেও তা কখনোই রসের নির্ধারক রূপে ধার্য হতে পারে না। এইভাবে ছবিতে উঠে আসে বিমূর্ত কলা রসের বৈচিত্র্যতা। সেকুলার আর্ট ফর্মে বিমূর্ততার ধারা সঞ্চারিত হলে এক সজীব ঐকানুভূতির সৌন্দর্যবোধকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। সৌন্দর্যের সে সুষ্টু প্রকাশের ক্ষেত্রে টেম্পেরামেন্ট অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। শিল্পবস্তু এবং শিল্পরূপ দুটো অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে ব্যক্ত হয়ে নতুন সত্তার সৃষ্টি করে ছবিতে। রেখা, রঙ, আলো, ছায়া, আকারের সার্বিক আবেদন অর্থবহ হয়ে ওঠে তখনই যখন টেম্পেরামেন্ট নিজের সূর মূর্ছনাকে সঠিক ভাবের উপাদান দ্বারা পরিচালিত করে। ভারতীয় শিল্প রীতিতে ভাবের ব্যঞ্জনা অবজেক্টটিভিটিকে ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত। স্থান ও স্থানিকতার সার্বিক আবেদন শিল্পবোধের পরিসরে অসংখ্য প্যাটার্নকে সমগ্রতায় একত্রিত করে। এইভাবে চিত্রকলা হেগেল বর্নিত ‘too objective’- হয়ে থাকার বদলে সেকুলার আর্ট ফর্মের ছত্রছায়ায় ও বিমূর্ত শিল্পভাবের আশ্রয়ে ক্রমশ প্রাচীনকাল থেকে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে এসেছে মুক্ত শিল্প রূপ লাভের মধ্য দিয়ে।
ভারতীয় গুহা চিত্রের ক্ষেত্রে ছবির টেম্পেরামেন্ট সুললিত। রঙের চাইতে রেখার দাপট সেখানে বেশী। রেখা প্রতিসাম্যমূলক কম্পোজিশনের মধ্য দিয়ে নানান কাহানীকে বর্নণা করে চলেছে। কোথাও চড়া রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। পারসপেকটিভ এই সকল গুহা চিত্রের অপর এক মহামূল্যবান সম্পদ যা ভারতীয় চিত্রকলাকে অনিবার্য ভাবে শিল্প বোধের অনন্য পর্যায়ে উত্থিত করেছে। পারসপেকটিভের অভিনবত্ব গুহাচিত্রকে সার্থকভাবে আখ্যান সৃষ্টিতে সার্থকতা পেয়েছে। গুহাচিত্রের কম্পোজিশনে টেম্পেরামেন্ট উৎসাহিত করেছে ছবিকে প্রয়োজনমত সঙ্গতি ও সংযম স্থাপনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে। আর এইভাবে গুহাচিত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট ফর্ম সৃষ্টিতে একান্তভাবে উপযোগী হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য শিল্প কলার মাল্টিপল ভিশনের কাজ ভারতীয় গুহা চিত্রে দেখা যায় না ঠিকই কিন্তু বস্তুতপক্ষে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতের মাপজোগ দর্শককে ছবির অঙ্গ হিসেবে দৃশ্য জগতের সঙ্গী করে তুলতে পুরোপুরি পারদর্শিতা অর্জন করেছে বারবার। এইভাবে ভারতীয় গুহাচিত্রগুলো টেমেরামেন্টের এক অমোঘ নিদর্শন হয়ে থেকে গিয়েছে যুগ যুগ ধরে। রঙ নয় রেখাই এই সকল ছবিকে আলো ছায়ার রূপরেখা নির্ধারণে সফলতা দিয়েছে। ভারতীয় ছবির টেমপেরামেন্টের উৎকর্ষতা ধরা পড়ে মিনিয়েচার ফরম্যাটের মধ্যেও। মিনিয়েচার ছবিতে রঙের চাপা অভিব্যক্তি টেম্পেরামেন্টকে দিয়েছে ছবির ক্ষেত্রে বিশেষ এক চরিত্রের রূপ। মিনিয়েচার টেকনিকে সংহতি যাতে নষ্ট না হয় সেদিক হতে ড্র্য়িং যতখানি পারদর্শিতা অর্জন করতে সফল ঠিক তেমনি ভাবেই রঙের বন্টনকেও হতে হয় অনেক বেশী মৃদুমন্দ্র মায়াময় ও সুললিত। মিনিয়েচার ছবির রেখার চলন আলোকে অপূর্ব ভাবে সংশ্লেষন করে কম্পোজিশনকে সার্থকতা প্রদান করে। রাজস্থানী তথা রাজপুত মিনিয়েচার যে টেনশন সৃষ্টি করতে সার্থক তার বিশিষ্ট চরিত্র ফুটে ওঠে আন্তরিকবোধ এবং অনুভূতির প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। মিনিয়েচার ফরম্যাটে তাই ফ্যান্টাসির তুলনায় রিয়েল অবজেক্টকে অথবা বাস্তব জগতের খুঁটিনাটিকে কোথাও ক্ষুন্ন না করে উপস্থাপন করা হয়। রিয়ালিজম মিনিয়েচার ভঙ্গিমাতে এক নতুন রূপলাভ করে থাকে। মিনিয়েচারের ছদ্ম তাই অনবদ্য, এই প্রকাশ সুন্দর। আকশ্মিকতার কোনো স্থান এই শিল্প রীতিতে নেই বললেই চলে।
পারসপেকটিভগত ভাবে মিনিয়েচার শিল্প রীতির অভিনবত্ব ছবির সম্পদ স্বরূপ।মিনিয়েচারের পারসপেকটিভ পাশ্চাত্য পারসপেকটিভের চাইতে সম্পূর্ন ভিন্ন এমনকি পরিপন্থী। ভ্যানিশিং পয়েন্টের ব্যবহারের তুলনায় এখানে হরাইজেনটাল তথা ডায়াগনাল পারাসপেকটিভ দিয়ে ছবিতে বহুত্ব নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়। ছবির উপজীব্য ধারাবাহিকতায় কাহানী বর্ননে এই প্রকার পারসপেকটিভের রস সঞ্চারণা বিশেষ মাধুর্য এনে দিয়েছে। মিনিয়েচার শিল্পের মাধ্যমে শিল্পের সামগ্রিকতা প্রতিফলিত হয় এবং টেম্পেরামেন্ট ছবিতে বিচিত্রগামী ধারাবাহিক ঐতিহ্যকে সার্বিক রস সঞ্চারণার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত করে থাকে। টেম্পেরামেন্ট শিল্পের ঐশী শক্তির ধারক ও বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ন। আখ্যানধর্মী মিনিয়েচার ছবির ক্ষেত্রে পারসপেকটিভ এবং টেম্পেরামেন্ট তাই বিলক্ষণ প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে, নিখুঁত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ছবিকে করে তুলেছে কালজয়ী।
টেম্পেরামেন্ট ও ভারতীয় ছবি নিয়ে আলচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ডের তেলরঙ ছবি নিয়ে আলোচনা না করা হয়। রাজা রবি বর্মা এ সময় এঁকে চলেছেন একের পর এক মাস্টার পিস। ভারতীয় দেব দেবী ও পুরাণকে নির্ভর করে ইউরোপীয় শৈলীকে কাজে লাগিয়ে তিনি যে ছবির বিনির্মানগুলো করে চলেছিলেন সেখানেও টেম্পেরামেন্ট এক মূর্ত চরিত্র স্বরূপ। প্রিন্ট মিডিয়া আসার ফলে ছবিতে তেল রঙের ব্যবহারের পাশাপাশি ছবি ছাপতে শুরু করল প্রেসে। রেখা ও আকারের পাশাপাশি ছবিতে কালার টেম্পেরামেন্ট প্রথম প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করল। কালার রিদমকে ধরে রাখতে এবং রিয়ালিস্টিক প্রকাশ ভঙ্গিমাকে ভাস্বর ভূমিকায় উপস্থাপিত করতে ছবিকে হয়ে উঠতে হয়েছে শিল্প সমন্বয়ের রূপ প্রকাশের যথাযথ বিশ্লেষিত আত্মপল্ধি স্বরূপ। শিল্প রসিক যাতে ঐক্য বোধের মধ্য দিয়ে মানসিক প্রশান্তিকে খূঁজে পায় সেই মর্মে ছবিকে হয়ে ইঠতে হয়েছে পরিমিত ভাবরসের যথার্থ সমন্বয়কারী। এখানে শিল্পী জীবনের লড়াই শুরু হয়েছে। সত্যকে রক্ষার জন্য রাজা রবি বর্মার জীবনেও ঘটে চলেছে একের পর এক ছবির সঙ্গে সংঘাত। এ প্রসঙ্গে রঁলার একটি উক্তিতে শিল্পী জীবনকে যথার্থ বর্নণা করে- ‘Be truth even through art and artist have to suffer for it! If art and truth cannot live together then let art disappear.’ শিল্পের দহন এখানেই শিল্পীর কল্পলোকের স্পর্শ পেতে তৎপর হয়, সচেষ্ট হয় শিল্প ছন্দকে জীবন সুন্দরের মধ্য দিয়ে শাশ্বত করে তুলতে।
বস্ত আশ্রিত শিল্প এইভাবে সঠিক টেম্পেরামেন্ট লব্ধ হয়ে ওঠে যথাযথ টেনশনের মধ্য দিয়ে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কথায় – শিল্পী যখন নিরবিচ্ছিন্ন গতি উপলদ্ধি করে তখন তার শিল্পে দেখা দেয় রস সৌন্দর্য। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই গতিকেই বলা হয় ছন্দ বা Tension। ছবির টেম্পেরামেন্টেই নিদির্ষ্ট করেছে ছবির গতিমুখ। বিশদভাবে ছবিকে দর্শকের সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম হতে প্রয়োজনীয় টেনশনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। টেম্পেরামেন্ট ও টেনশনের এই মিলমিশটাই হল আর্টের গোড়ার কথা। বিষয়বস্তু সেখানে আর মুখ্য থাকে না। বিমূর্ততা রচনার মধ্য দিয়ে শিল্পের স্পর্শ নতুন সৃষ্টির সুবিন্যাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। আসেলে আর্ট তো কোনো পদার্থ নয় যার হাত ধরে নিজস্ব ধারণা অথবা বিচিত্র মতের প্রকাশ করা সম্ভবপর হবে। আর্ট হল জীবন চর্যার এক মূল সূত্র। শিল্প তাই বিচিত্রগামী হতে পারে কিন্তু কখনই সর্বত্রগামী হয় না। শিল্পের ধারাবাহিক ঐতিহ্য তাই শিল্পের ধারাকে নতুন দিশা দেখাতে তৎপর হয়। বিমূর্ততা ও বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে শিল্প ধারার অখন্ডতা। এই অখন্ডতাকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে- যথা শিল্পভাব, শিল্পবস্তু এব শিল্পপ্রকাশ। শিল্পের নন্দনতত্ত্ব নৈর্ব্যক্তিকতার পথে চলার মর্যাদা অর্জন করেছে। শিল্পের প্রকাশ বৈচিত্র্যতা নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পেয়েছে গাঢতা। নৈর্ব্যক্তিকতা বিমূর্তবাদের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কল্পনাকে করেছে ছবির মূল রসদ স্বরূপ। এইভাবে ছবিতে রস বোধ কল্পনাকে কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। একদিকে যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিত্রকলা ভারতীয় ছবির জগতকে পুষ্ট করেছে তেমনি অন্যদিকে সেকুলার আর্ট ফর্ম শিল্পীর অন্নবস্ত্রের সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি হয়ে উঠেছে ভারতীয় চিত্র নির্মান নীতির স্বকীয়তা স্বরূপ। কেবলমাত্র বিমূর্ত আকার পরিচর্চার মধ্য দিয়ে শিল্প জগত আবর্তিত হয় না শিল্পীর দায়িত্ববোধ পরিচালিত হয় সেকুলার এলিমেন্টকে শিল্পবদ্ধ করে তুলতে।

শিল্প ও শিল্পীর জগত তাই বিচিত্র সত্তা নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। ভাষা ও আঙ্গিকগতভাবে ছবির উন্মোচন হয় যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। প্রকৃত রসবোধে উত্তীর্ন ছবি তাই সর্বদাই টেম্পেরামেন্টের দিক হতে অর্থব্যঞ্জক। মুক্ত বিচারের পথ সেখানে সর্বদা খোলা থাকে। ভাবমুখী বিশ্লেষণ যেমন আকার পায় তেমনি বৈচিত্র্যতা ও বিমূর্তাতাও শক্তিশালী এলিমেন্ট হিসেবে ছবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। শিল্প হয়ে ওঠে রস লোকের উৎকর্ষ এক উপাদান। গ্রহনযগ্যতা ছবির পরিসরকে অনেক বেশী পদবাচ্য হয়ে উঠতে সাহা্য্য করে। এ ক্ষেত্রে এই লেখায় ছবির বাজারমূল্যের দিকটিকে একেবারেই বিচার্য হিসেবে রাখা হ্য় নি। ছবির টেম্পেরামেন্টের নির্নায়ক হিসেবে এখন বাজার মূল্য এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। আধুনিক শিল্পে ভারতীয় ছবির বাজার ও ছবির টেম্পেরামেন্ট সম্পূর্ণ আলাদা বিশদ আলচনার দাবী রাখে। ভারতীয় ছবির বিবর্তনের পথে ক্লাসিক্যাল পিরিয়ডে ছবির টেম্পেরামেন্ট নিয়েই এই লেখায় অতএব শিল্প শৈলীর গুনাগুন আলোচিত হল। ছবির টেম্পেরামেন্ট সর্বজন গ্রাহ্য আবেদনকে তথা শিল্পের সাবজেক্টিভিটিকে সমগ্রে পরিণত করতে পারলেই ছবির যথার্থতা ও সৌন্দর্যের ধারণা প্রকাশিত হয়।