শেষ দিনে এসে চিতার পাশে দাঁড়াবে?
দাহ করে ফিরে সন্তানকে চিনিয়ে দিও... ওওই দেখ অরিয়ন
মাকে বলে চলেছি কবর ছাড়া অন্য কিছু নয় কিন্তু
কেমন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে
কি জানি! হয়তো ভাবে
শামুখ এতো ভয় পায় মেয়েটা,
পিঁপড়া মারে অকারণে
একদিন তো বলেই দিল, ওসব হবে না রে
মাটির নীচে তোর ঠান্ডা লেগে যাবে
তুমি বরং সেখানে নেমে মাফলার দিয়ে এসো। তোমার রুমাল রেখে আসবে পাশে। কিছু হারালে গিঁট দেবো, অন্ধকারে ঠিক টেপজামা হারিয়ে ফেলবো তুমি জানো,
একটা পায়ের মোজাও খুঁজে পাচ্ছিনা
শরীর খারাপ করলে ডাক্তার সেখানে যেতে পারবে না, এই যা মঙ্গল।
আচ্ছা মাটির নীচে কি বালি থাকে? নাকি কেবলই তাল তাল মাটি!
কিছু বালি একটা কাগজে মুড়ে নিয়ে যেও
রেখে এসো মাথার দিকটায়
ছোটবেলার সেই খেলাটা খেলবো
মা চিল্লিয়ে গলা চিরে ফেলছে
গরম জল ঠান্ডা হয়ে বরফ হয়ে যাবে এবার…
উঠলি তুই অই খান থেকে… আর আমি থেবরে বসে, বাগানের বালি, একটু দানা দানা; বাগানের সেই বালি এনে উঠনে পা ছড়িয়ে বসে মাথায় ঢালছি। স্নান সেরে উঠে সারা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা মাথায় আঙুল খুঁচিয়ে সে বালি টেনে টেনে আনবো আর মাটির তল থেকে চুলগুলো সব উঠে আসবে উপরের দিকে, ধরো একটা গাছ মাটির তলায় পুতলাম আর সে গাছ শিকড় ছড়িয়ে পৌঁছে গেল আকাশের কাছাকাছি। কিছু পাখী তখন সন্ধ্যায় বাড়ী যাওয়ার পথে আমার চুলের শিকড়ে বসে ডাকবে… ঠাকুর গোপাল…
ও ও ও ও ও ঠো… ও ও ও ঠো… ও ঠো…
এই পাখীটা ডাকলে বাবার গন্ধ ছড়িয়ে যায়
অস্থির অসাড় ধড়ফড় করে ঘুমের ভিতর উঠে বসে বিছানায়
সারাদিনের বিভ্রান্তির ঘোর কাটিয়ে বাজারে যায়
ঐ একটাই সেবা দিয়েছে পাখীটা নিয়ম মেনে জীন্দেগীভর
বাজার থেকে কাঁকড়া আসতো
বর্ষার জল ডোবায় উপচে উঠলে
ট্যামন কোঁচা নিয়ে কাঁকড়া মারতে বের হয়
ট্যামনের একটা লিকলিকে মন ছিল
আর ছিল ট্যারা দুই চোখ।
দুই চোখ ট্যারা হলে বুঝি কারো নাম ট্যামন
দিতে হয়? বাতাসা লুকিয়ে রাখতাম।
সারা বিকেল বর্ষার জলে বাতাসা মুঠি করে ড্রেনের পাড়ে টাকী খুঁজতাম। আঠা থিকথিকা হাতের তালু থেকে বাতাসা তুলে মুখে পুড়েই সুতো ধরিয়ে দিতো ট্যামন… বলতো বড় হয়ে তোকে একদিন একটা জাল আমি ঠিক কিনে দিবো। হেব্বি হবে মাইরি! তুই আর আমি জাল ছড়াবো মতির ডোবায়। সুতায় টান পড়ত… লাল এক কাঁকড়া সন্ধ্যার ভরা ড্রেনের ধার ঘেসে মতির মতো চকচকে জলের আলো গায়ে মেখে হেঁটে হেঁটে বাড়ী ফিরত। এরপর কিছুদিন ড্রেন- ডোবা- রাস্তা একাকার হয়ে বৃষ্টি হল খুব। অনেক বৃষ্টির সময় মাটির তলে কি হ্য়? হড়হড় করে জল নামে? কবরের সবাই বুঝি স্নান করে সেই জলে। অত অন্ধকারে স্নানের পরে গামছা কোথায় পাব বল’তো! চিরুনীটাই বা কোন বইয়ের ভাঁজে রেখেছো মনে কি আর আছে? বৃষ্টি কমতেই ট্যামন এসে বললো-
- চল্ আজকে ভালো কই উঠবে…
- আমাকে খইলসা দিবি দুইটা।
- বললাম তো কই উঠবে!
- না আমার খইলসাই চাই। রঙিন। এই দ্যাখ হরলিক্সের বোতল জোগাড় করেছি…
- এইটা না দুইদিন আগেই আনলো বাড়ীতে, শেষ! হেব্বি খাস মাইরি তুই…
- হ্যা। সব খায়ে ফেললাম, খিদা পায় খুব। দুপুরে বইসে বইসে খায়ে ফেললাম তো,কিছুতেই পেট ভরলো না তাও…
কবরের ভিতর দিয়ে কি দারুণ সব পিঁপড়ারা যায়, হাত বাড়িয়ে টপাটপ সেগুলোকে টিপে টিপে মারতে মারতে হাতের আঙুলগুলো গেল খুলে। কব্জির হাড় দুটো দিয়ে বাড়ি মারতেই মাটির দলা, তেতুলবিছা, শামুখের খোলা সব নাকে-চোখে-মুখে। কানের এফোড় ওফোড় ঢুকে হুড়মুড়িয়ে কেঁচোর দলা মাথায় উঠে আসতে চাইছে। ট্যামন ড্রেনের বাঁকটায় হাত ডুবিয়ে চ্যাঙ মাছগুলোকে ধরার জন্য হাঁটু মুড়ে নিঃশব্দে হাত নামিয়ে দিলো জলে, ওপর থেকে দেখলে বোঝা যায় না ট্যামনের হাতের তাবিজ অব্দি জল গভীর সেখানে। যতবার হাত ডোবায় চ্যাঙটা ঢুকে যায় কাদায়। ও আবার হাত তোলে আবার খানেক দূরে, আরো শান্ত আরো নিপুন আরো নিস্তব্ধে ডুবিয়ে দিচ্ছে হাত। ট্যামন বলে, একটু যদি জাল থাকতো রে হাতে, তোকে আজ খইলসা ধরে দিতাম… অই দ্যাখ খইলসা দুটা খেলছে, রঙিন। কালভার্টের গোড়ায় এসে জলটা শব্দ করে গর্ত মতো জায়গায় যেখানে পড়েছে সেখানে খেলা করছে দুটা রঙিন খইলসা। কিন্তু অতো গভীর থেকে হাত দিয়ে তো আর তুলে আনা যাবে না; দুম করে খুলে ফেললাম একটানে গায়ের টেপজামা…
পাখী আঁকা, আমের রসের ছোপ লাগা, ছেঁড়া হুক
সাদা যে টেপজামাটা পড়ে আছি, একটানে খুলে ঝুঁকে টানটান দুটো পাশ ধরে রেখেছি হাঁটুমুড়ে…
অন্য দুই প্রান্ত কোণা করে হাঁটু জলে নেমে
জলের তলায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে টেপজামাটাকে ট্যামন…
গাছের প্রশাখা জড়িয়ে পাতাগুলো শিরদাঁড়ার আনাচে কানাচে উঁকি দিচ্ছে।
এতো ধ্যানস্থ বুঝি মানুষ কেবল কবরের নীচেই থাকতে পারে।
কবরে শুয়েই হয়তো বা সঠিক অর্থে আকাশ পাতাল ভাবা যায়।
একটা শিরদাঁড়া যদি সর্ব্বোক্ষণ মাটি পায়য়য়য়য়য়য়য়য়য়য়য়য় তবে সেখানে ঘাস গজায় কি?
খুব সন্তর্পনে সাদা টেপজামার ওপরে, ঝকঝকে জলের ওপরে দুটো রঙিন খইলসা ঘুর ঘুর করছে। ততোধিক নিপুন তালমেলে আমরা ছোট করে আনছি টেপজামার গলুই। সুরুত ক’রে একতাল শ্যাওলা জড়িয়ে এলো। যে ভাবে কবরের ভিতর ছোট হয়ে আসে বেঁচে থাকা। চারকোণা এক করে জল থেকে টেনে তুলে মাছদুটোকে পট করে শ্যাওলা সমেত ঢেলে দেয় ট্যামন হরলিক্সের বোতলে। ভেজা টেপজামা ফেরত নেওয়ার সময় শেষবারের জন্য দুইজন দুজনের দিকে তাকিয়ে জিতে যাওয়ায় হাসি হেসেছিলাম। শেষবারের মতো ক্যামন ঝুপঝুপা ভেজা চোখ নিয়ে ফেরার সময় খইলসার বোতল কোলে নিয়ে হাইড্রেনের পাশে বসে পা চুবিয়ে বাতাসা খেলাম সন্ধ্যার আগে। এত জলের তোড়ে পায়ের পাতা চারটা হড়কে যায়, ঠক ঠক শব্দ করে কালভার্টে। ট্যামনের চোখে জলের ছায়া পড়ে, বিড়বিড় করে বলে… তোকে একদিন একটা জাল আমি কিনে দিব মাইরি, একদিন ঠিক একটা জাল হবে আমাদের, দেখিস তুই, একটা জাল তোকে আমি দিবোই দিব…
ঘরে ফিরে ধুম জ্বর। বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনে দিন যাচ্ছিল বেশ… একটু পরপর উঠে মুড়ি ফেলছি বোতলে। ঠিক যে দিন জল পাল্টে নতুন জলে লবন ঢেলে মুড়ি দিয়েছি সদ্য… সে সময় বাইরে হইচই। জ্বরের ধকল তখনো চোখে মুখে, বাইরে বেড়িয়ে দেখি সবাই ছুটছে বড় রাস্তায়। ক্যামন হাবাগোবার মতো ভীড়ের মধ্য দিয়ে গলে গলে একেবারে হাইড্রেনের সামনে- ট্যামন ভাসছে।
ফ্যাটফেটে সাদা। চোখটা সাদা। হাত-পাগুলা সাদা, আঙুল গুলান সাদা।
হাইড্রেনের কালভার্টে পাতা জালে পা প্যাচায়ে
বাড়ী খাচ্ছে ঠুক ঠুক… ডুবে যাচ্ছে… আবার ভেসে উঠছে… আবার ডুবে যাচ্ছে… আবার ভেসে উঠে বাড়ী মারছে কালভার্টে…
ট্যামনের হাতের তাবিজে জলের ধাক্কা।
শরীর ফুফুফুফুফুফুফুফুফুফুফুফুফুলেলেলেলেলেলেলেলেলেলেলেলে বেলুন।
এর বাইশ বছর পর সত্যি সত্যি একদিন জাল কিনে দিয়েছে ট্যামন। একখানা আস্ত জাল সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে বাইশ বছর আগেই বাড়ী ফিরে শুয়ে পড়েছিলাম কবরে। এতদিন পড়ে কবর থেকে বেড়িয়ে জাল কিনে দিয়েছে ট্যামন আমাকে। আর আমি ওই খইলসার বোতলের মুখে ঢাকনা এঁটে বাইশ বছর পরে হাইড্রেনের কিনারে দাঁড়িয়ে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম বোতলটাকে। কালভার্টের কিনারে আটকে ঠুক ঠুক শব্দ করে ডুবে গেল হরলিক্সের বোতল দুইটা খইলসা মাছকে নিয়ে।
কবরে ফেরার দিন এই তো সসসসসসসসসসসসসসসবে শুরু।
তুমি জালে মুড়ে
ফেলে এসো কবরকে আমার
আমার কবরের কিনারে
কবরের পাশ থেকে ফিরে আকাশের তারা দিয়ে ভাত মেখে মুখে তুলে দিও তোমার সন্তানকে…